“একজন উদ্যোক্তার বাজেট ভাবনা”

মাননীয় অর্থমন্ত্রী মহোদয় ২০১৮ -২০১৯ সালের জন্য ৪ লাখ ৬৪ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকার বাজেট জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করেছেন ।

আমি আসলে কোন অর্থনীতিবিদ, কোন বাজেট বিশেষগ্ নই, একটি বাজেট উপস্থাপন করার পর আসলে আমার মনে কি ভাবনাটা/ভাবনাগুলো ভেসে উঠে সেগুলোই আজকে আপনাদের সাথে শেয়ার করবো ।

আসলে যে কোন অর্থ বছরের বাজেট প্রকাশিত হওয়ার পর আমার ভাবনা বা অনুভুতিগুলো ২ ভাবে কাজ করে ।

প্রথমত আমি একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসাবে বাজেট আলোচনার পরের দিন পেপার পত্রিকা, টেলিভিশন এর মাধ্যমে জানার চেষ্টা করি যে , এবার বাজেট প্রদান করার ফলে আগামী অর্থ বছরে কোন কোন জিনিস পত্রের দাম বৃদ্ধি পাবে এবং কোন কোন জিনিস পত্রের দাম কমবে অর্থাৎ কোন কোন জিনিস কম করে কিনতে হবে, কোন জিনিসটা বেশি কেনা যাবে ।
এবং প্রস্তাবিত বাজেট এর ফলে কোন স্বপ্নটা নাগালের মধ্যে থেকে বেড়িয়ে হারিয়ে গেল আর কোন স্বপ্নটা বেচে থাকার জন্য নতুন করে দেখতে হবে ।

একজন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হিসাবে যেহেতু আমার কন্ঠস্বর এ এতটুকু জোর নেই যে, আমি আমার চাওয়া-পাওয়াগুলো বাজেট আলোচনা বা সরকারের কাছ পর্যন্ত পৌছে দিতে পারি । তাই বাজেট আমাকে যেভাবে পরিচালিত করবে আমি / আমার মতো কোটি কোটি মধ্যবিত্তের সন্তানদের সেভাবেই নিজেকে বদলে নিয়ে বেচে থাকতে হবে । তাই এ ব্যাপারে বাজেট নিয়ে আমার তেমন কোন আগ্রহ বা কোন ভাবনা আমাকে বিচলিত করে না ।

কিন্তু কয়েক বছর আগে আমি আমার চাকরী জীবন এর অবসান ঘটিয়ে একটি উদ্যোগ শুরু করেছি এবং আমার উদ্যোগ এর কাজই হচ্ছে আমার মতো আরো যারা ছোট উদ্যোক্তা রয়েছে তাদের সাথে কাজ করা তাদেরকে তথ্য দিয়ে তাদের উদ্যোগকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া । তাই বিগত দুই – তিন বছর ধরে বাজেট প্রকাশিত হওয়ার পর কিছু বিষয় নিয়ে একটু খোজ খবর রাখতে হয় ।

আমার মতো যারা ছোট উদ্যোক্তা রয়েছে তাদেরকে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে দুটি বিষয় একটি হলো ট্যাক্স এবং অন্যটি হলো ভ্যাট ।

আমরা যদি এবারের আয়করের হার এর যে ঘোষনা রয়েছে সেটার দিকে দেখি তাহলে তেমন কোন পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায় না আগের অর্থ বছরের মতোই এবারও পুরুষ করদাতাদের জন্য করমুক্ত আয়ের সীমা রাখা হয়েছে ২,৫০,০০০/- এবং নারী করদাতাদের জন্য ৩,০০,০০০/- এছাড়াও বিশেষ কিছু শ্রেনীর জন্য বিশেষ কিছু করমুক্ত হারের কথা উল্লেখ রয়েছে ।

এখানেই আমি একটি দৃষ্টিপাত করতে চাই,

আমি যতটুকু জানি অনেকগুলো নারী উদ্যোক্তা সংগঠন এবং নারী সংগঠন এর দাবীর কারনেই কিন্তু নারীদের জন্য বিশেষ সুবিধা বাবদ পুরুষদের চাইতে ৫০ হাজার টাকা বেশি করমুক্ত হার সরকার নারীদের জন্য প্রদান করেছেন ।

এটা নির্দিধায় নারী সংগঠনগুলোর জন্য একটি বিশেষ পাওয়া । কিন্তু এতে আসলে আমরা কতটুকু লাভবান হচ্ছি সেটা একটা বড় প্রশ্ন ? এই ৫০ হাজার টাকা বেশি করমুক্ত হার পাওয়ার কারনে কতটুকু সুবিধা নারীরা ভোগ করতে পারছেন বা আদৌ এতে কোন লাভ হচ্ছে কি ?

একজন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তার দৃষ্টিতে আসলে আমার কাছে মনে হয়েছে যে, নারী এবং পুরুষ এর জন্য আলাদা , আলাদা করমুক্তের হার হওয়ার কারনে নারী এবং পুরুষ করদাতারা দুটি শক্তিতে বিভক্ত হয়ে পড়েছেন । এই নারী এবং পুরষ করদাতাদের মধ্যে একটি বড় অংশ কিন্তু রয়েছে উদ্যোক্তা ।
আমরা যদি এই উদ্যোক্তা শ্রেনীকে আলাদা করে সকল নারী এবং পুরুষ উদ্যোক্তাদের জন্য একটি আলাদা করদাতা শ্রেনী তৈরী করতে পারতাম তাহলে আমরা আরো বেশি করে বাজেট এর সাথে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারতাম এবং আরো বেশি করে আমরা সরকারের কাছ থেকে যেমন সুবিধা নিতে পারতাম ঠিক তেমনি সরকারকে সুবিধা দিতেও পারতাম ।
কিন্তু কথা হচ্ছে বেড়ালের গলায় ঘন্টাটা বাধবে কে ?
প্রতি বছরের মতো এ বছরও বাজেট উপস্থাপনার আগে প্রাক বাজেট আলোচনার মাধ্যমে বহু সংগঠন তাদের চাওয়া পাওয়া, দাবী – দাওয়া উপস্থাপন করেছেন এবং বাজেট উপস্থাপন করার পর আবার অনেক সংগঠন তাদের প্রতিক্রিয়া ব্যাক্ত করেছেন যার যার মতো করে । যাদের মধ্যে উদ্যোক্তা বা ব্যবসায়ীক সংগঠনই বেশি ।

কিন্তু খেয়াল করার বিষয় হলো প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান তার নিজ নিজ জায়গা থেকে, নিজ নিজ সুযোগ-সুবিধার কথা বলছি কিন্তু কেওই কিন্তু আমরা সামগ্রিক উদ্যোক্তা উন্নয়ন বা একটি উদ্যোক্তা বান্ধব পরিবেশ তৈরীর কথা বলছি না । আর বলছি না বলেই কিন্তু আয়করের যে সকল করদাতা শ্রেনী রয়েছে তার মধ্যে উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা কোন করদাতা শ্রেনী এখন পর্যন্ত আমরা তৈরী করতে পারিনী ।

বাংলাদেশে এখন বহু সংগঠন রয়েছে যারা বর্তমানে উদ্যোক্তা উন্নয়নে কাজ করে চলেছে কিন্তু কেন জানি এই সকল সংগঠনগুলোর মধ্যে একটি সমন্বয় এর অভাব পরিলক্ষিত হয় ফলে আমরা নিজেরা যেমন ১ থেকে ১০০, ১০০ থেকে হাজার, হাজার থেকে লক্ষ , লক্ষ থেকে কোটিতে রুপান্তরিত হতে পারি না । ঠিক তেমনি সরকারের বর্তমান যে সকল উদ্যোক্তা উন্নয়ন কর্মসূচী রয়েছে সেখান থেকেও আমরা তেমন কোন সুবিধা নিতে পারি না ।
ফলে উদ্যোক্তা শ্রেনীর জন্য আলাদা করে একটি করদাতা শ্রেনী তৈরীর জন্য যে পরিমান আওয়াজ তোলা দরকার সে পরিমান আওয়াজ আমরা এখনও তুলতে পারিনি ।

এবার একটু দৃষ্টি দিতে চাই ভ্যাট এর দিকে । একজন নতুন উদ্যোক্তা যদি একটু গুছিয়ে, একটু বড় করে নতুন কোন উদ্যোগ শুরু করতে চান তাহলে যে যে জায়গাগুলোতে তার উদ্যোগ শুরুর সময় ভ্যাট প্রদান করতে হবে তাহলো , কোম্পানী রেজিষ্ট্রেশন করার সময় ১৫% ভ্যাট, ট্রেড লাইসেন্স করার সময় ১৫% ভ্যাট, ট্রেড মার্ক এর উপর ১৫% ভ্যাট, আমদানী ও রফতানী সার্টিফিকেট এর উপর ১৫% ভ্যাট অর্থ্যাৎ আপনি যতো জায়গা থেকে সরকারী লাইসেন্স বা সেবা গ্রহণ করবেন মোটামোটি সকল জায়গাতেই আপনাকে ১৫% করে ভ্যাট দিতে হবে ।

শুরুতেই যখন একজন নতুন উদ্যোক্তাকে বিভিন্ন লাইসেন্স বাবদ ভ্যাট প্রদান করতে হয় তখন স্বাভাবিক ভাবেই তার মনে একটা প্রশ্ন জাগে “ব্যবসা শুরু করতেই এতো জায়গায় ভ্যাট দিতে হচ্ছে, ব্যববসা পরিচালনা করতে না জানি কত জায়গায় ভ্যাট দিতে হয় ?”
এবং তার মধ্যে ভ্যাট প্রদান করার ক্ষেত্রে এক রকম ভীতি তৈরী হয় ফলে সে পরবর্তীতে ভ্যাট প্রদান বা ক্রেতা সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে ভ্যাট সংগ্রহ করে সরকারী কোষাগারে জমা দিতে অনাগ্রহী হয়ে উঠেন ।

অথচ আমরা যদি সবাই মিলে নতুন উদ্যোক্তাকে এমন একটি সুবিধা প্রদান করতে পারতাম যে, উদ্যোক্তার উদ্যোগ তৈরী করতে কোন প্রকার ভ্যাট প্রদান করতে হবে না কিন্তু যখনই তিনি তার পণ্য বা সেবা বিক্রয় শুরু করবেন তখন থেকে তিনি ক্রেতা/সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে ভ্যাট সংগ্রহ করে সরকারী কোষাগারে জমা দিবেন, নিজের উদ্যোগ এর ভ্যাট সহ তাহলে মনে হয় এই ভ্যাট এর ভীতি টা আর থাকতো না ।
আমার বিশ^াস তাহলে উদ্যোক্তাদের মধ্যে থেকে যেমন ভ্যাট প্রদানের ভীতি দুর হয়ে যেত ঠিক তেমনি তারা আরো অধিক মাত্রায় ভ্যাট সংগ্রহ করতে সরকারকে আরো বেশি করে সহযোগীতা করতো ।
লক্ষনীয় একটি বিষয় হলো, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এবং উদ্যোক্তারা সব সময়ই যেন বিপরীতমুখি একটা মনোভাব প্রকাশ করে থাকে । বিপরীত মুখী মনোভাব বলতে আমি বলতে চাইছি আরো একটু বেশি বন্ধুভাবাপন্ন সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারলে , ট্যাক্স এবং ভ্যাট সংগ্রহের চিত্রটাও পাল্টে যেতে পারে বলে আমার বিশ^াস ।
প্রতি বছর এনবিআর শ্রেষ্ট/সর্বোচ্চ আয়কর প্রদান করেন এমন ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠানকে পুরস্কৃত করে থাকেন এবং স্বাভাবিক ভাবেই এই সকল পুরস্কারগুরো বড় বড় প্রতিষ্ঠান, শিল্পপতি যারা আছেন তারাই পেয়ে থাকেন ।

তাহলে ক্ষুদ্র ও মাঝারী উদ্যোক্তারা উৎসাহীত হবে কি করে ?
আমরা কি পারি না বাংলাদেশ ব্যাংক এর উদ্যোক্তা বিষয়ক যে সিলিং বা বিভাজন রয়েছে সেই অনুযায়ী আরো অধিক সংখ্যক পুরস্কার প্রদান করতে । আমরা কি পারি না ক্ষুদ্র , মাঝারী উদ্যোক্তাদের আরো কাছাকাছি এনবিআরকে নিয়ে যেতে । যদি এটা করা সম্ভব হয় তাহলে কিন্তু ক্ষুদ্র ও মাঝারী উদ্যোক্তারাও ট্যাক্স এবং ভ্যাট দিতে আরো বেশি উৎসাহিত বোধ করবেন ।

২০১৮ সালের ফেব্রয়ারী মাসে অনুষ্ঠিত, বিশ^ অর্থনৈতিক ফোরাম এর এক জরীপে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের ৮২ শতাংশ তরুন ভালো জীবন যাপন ও পেশার উন্নতীর জন্য দেশ ছাড়তে চান এবং ৬৩ শতাংশ তরুন জানেন না যে তার জীবনের লক্ষ্য কি ?

আমাদের দেশের আনুমানিক ৬০ শতাংশ জনসংখ্যা ৩৫ বছরের নিচে ।
প্রতি বছর ২০ লাখ তরুন – তরুনী কর্মবাজারে প্রবেশ করছে । এর মধ্যে ৪৭ শতাংশ শিক্ষিত ¯œাতক বেকার । আর তাই ১টি পদের বিপরীতে ২ হাজারের বেশি আবেদন পরে একটি মাত্র চাকরীর আশায় ।
বিপুল কর্মসংস্থান একমাত্র তখনই সম্ভব যদি এর মধ্যে থেকে ৫-৭ শতাংশ নিজের কর্মসংস্থান নিজে তৈরী করে আর এই ৫-৭ শতাংশ কর্মসংস্থান তৈরী করা তখনই সম্ভব হবে যখন আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আমরা বাংলাদেশের জন্য একটি উদ্যোক্তা বান্ধব পরিবেশ তৈরী করতে পারবো ।

এখন সিদ্ধান্ত আমাদের ।
আমরা কি সবাই , যার যার সুযোগ সুবিধা নিয়ে কথা বলবো নাকি আমরা একটি সামগ্রীক একটি উদ্যোক্তা বান্ধব পরিবেশ তৈরী করতে একত্রিত হয়ে কাজ করবো । যাতে করে সরকার আরো বেশি করে উদ্যোক্তাদের সুযোগ সুবিধা দিতে পারেন এবং উদ্যোক্তারাও আরো বেশি করে ট্যাক্স ও ভ্যাট প্রদান করে দেশের উন্নয়নে জোড়ালো ভুমিকা রাখতে পারে । যাতে সামনের বছরে “বাজেট আমাকে কি দিলো এটা হিসাব না করে বাজেট থেকে আমরা কি নিতে পারলাম তার হিসাব করতে পারি”

নাহলে কবিতার ভাষায় হয়তো বলতে হবে
এ বাজেট আমার, তোমার, আমাদের বাজেট, উদ্যোক্তা বা তারুণ্যের বাজেট নয় ।

ধন্যবাদ ।
মো: আমিনুল ইসলাম
ফাউন্ডার এন্ড সিইও
শাহিন’স হেল্পলাইন



Leave a Reply