নিজেকে জানা কি খুব প্রয়োজন ?

কয়েকদিন আগে আমরা একটি প্রোগ্রাম করেছিলাম সিএসও সামিট (CSO Summit), এই প্রোগ্রামে যারা এসেছিলেন তাদের কাছ থেকে আমরা অনেক অনেক শিক্ষনীয় ঘটনা জানতে পেরেছি । সব মিলে চমৎকার একটি প্রোগ্রাম ছিল বিশেষ করে, উপহারগুলো ছিল অসাধারন । এই প্রোগ্রামে আমরা  স্পিকারদের কাছ থেকে, মানসিক সংগ্রাম, শারীরিক সংগ্রাম, অর্থনৈতিক সংগ্রাম সহ নানা ধরনের সংগ্রাম এর কথা শুনেছি শিখেছি অনেক কিছু ।
আমি আমার জীবনে একটি বিশেষ ধরনের সংগ্রাম করেছি, করছি ভবিষ্যতেও করতে হবে বলে আশা করছি । সেটি হরো আমি যাতে সংগ্রামী হতে পারি তার সংগ্রাম করা । সবাই কিন্তু সংগ্রাম করতে পারে না । অনেকেরই অনেক সীমাবদ্ধতার কারনে । আমিও নিজেকে সংগ্রামী করে গড়ে তোলার জন্য সেই কবে থেকে সংগ্রাম করে চলেছি । তারই কয়েকটা ঘটনা বলি ।
আমি তখন অনেক ছোট, ক্লাস থ্রি তে পড়ি কিন্তু এর পর আর যেন বড় হতে পারছিলাম না । একটি বিশেষ   কারনে থ্রি তে আমি তিনবার পড়তে হয়েছে । এতে আমার দুঃখ নেই কারন এই কারনে হয়তো অনেক কিছু বেশি শিখতে পেরেছি, অনেক নতুন বন্ধু পেয়েছি । সে যাই হোক থ্রি তে তিন বছর পড়ার পর যেটা হলো আমি আর আমার ছোট বোন এক সাথে এস এস সি পরীক্ষা দিলাম ।  আমার ছোট বোন অনেক ভাল ছাত্রী ছিল , সেই সময়ে মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে  যে কজন এস এস সি  পরক্ষীয় ২০ এর মধ্যে থাকবে বলে আশা করছিল স্কুল তার মধ্যে  ও ছিল । আমার অবস্থাটা হচ্ছে কোন রকম যদি ফেইল এর সিট এ নাম না এসে পাশএর সিট এ আমার নাম আশে তাহলেই আমি খুশি বাসার সবাই খুশি । আমার আম্মা আমার ছোট বোনকে পরীক্ষা দিতে নিয়ে যেতেন না উনি আমাকে নিয়ে যেতেন পরীক্ষা দিতে । যথারীতি পরীক্ষা শেষে রেজাল্ট এর দিন এলে আমার স্কুলটা ছিল বাসা থেকে বেশ দুরে আর মনিপুর স্কুলটা ছিল আমাদের বাসার কাছে কারন আমরা তখন মনিপুর থাকতাম । তো আমি রেজাল্ট দেখে বাসায় ফিরেছি । বাসায় এসে দেখি ব্যাপক খারাপ অবস্থা আমার ছোট বোন কান্নাকাটি করছে আর বাসার সবার মন খারাপ কারন আমার ছোট বোন সব বিষয়ে ভাল রেজাল্ট করলেও ২০ জনের মধ্যে আসতে পারে নাই  তাই এ অবস্থা । অবস্থার কিছুটা পরিবর্তন হলো এবং আব্বা আমাকে মিষ্টি কেনার জন্য টাকা দিলেন যখন শুনলেন যে আমার রোল নম্বর পাশ করা ছাত্রদের তালিকার মধ্যে পাওয়া গেছে । রেজাল্ট কি ছিল তা আর না বলি ।
আমি যখন পলিটিক্যাল সাইন্স এ মাষ্টার্স শেষ করলাম তখন একটা বিষয় আবিস্কার করলাম যে, আমার আব্বা হচ্ছেন আমাদের বংশের মধ্যে প্রথম ইন্জিনিয়ার । আমার বড় ভাই হলো আমাদের বংশের মধ্যে প্রথম ডাক্তার, আমার ছোট বোন আমাদের বংশের মেয়েদের মধ্যে প্রথম ডাক্তার ।আমার ছোট ভাই আমাদের বংশের দ্বিতীয় জেনোরেশন এর  মধ্যে প্রথম ইন্জিনিয়ার  । আমি কোন দিক থেকেই প্রথম নই কারন আমার আগে অনেকেই মাষ্টার্স পাশ করেছে । আমার সন্তান যদি আমার কাছে জানতে চায় বাবা সবাইতো ডাক্তার ইন্জিনিয়ার তুমি  কেন ডাক্তার ইন্জিনিয়ার হলে না ? আমি কি উত্তর দিবো তাই আমি আবার নতুন করে ভর্তি হলাম এমবিএ করার জন্য এবং আল্লাহ্ রহমতে ভাল ভাবেই পাশ করলাম । এবার আমি হলাম আমার বংশের মধ্যে প্রথম ডাবল মাষ্টার্স করা ব্যাক্তি । এবার সন্তান এর কথার উত্তর দেয়া যাবে ।
আমি আমার জীবনের একটি উজ্জ্বল সময় পার করেছি সরকারী  বাংলা কলেজ এর রোভার স্কাউটিং এর সাথে সম্পৃক্ত থাকার সময় । রোভার স্কাউটিং এর একটি অন্যতম কাজ  বা অংশ হলো ক্যাম্প । কিন্তু আমার সীমাবদ্ধতা ছিল যে, আমি কোনদিন কোন ক্যাম্প  যেতে পারতাম না কারন  একটি বিশেষ কারনে আমি রাতে বাসার বাহিরে থাকতাম না, নিষেধ ছিল উপর মহলের । তারপরও আমি এই সীমাবদ্ধতার মধ্যে দিয়েই আমি কলেজ রোভারিং এর সর্বচ্চো পদে আসীন ছিলাম  এস আর এম হিসাবে । আমি সাধারনত সব ক্যাম্পগুলোতেই ঘুরে আসতাম একদিন করে যদি সেটা  ঢাকার কাছাকাছি হতো । দিনে গিয়ে দিনে ফেরত আসব এই ভেবে কেরানীগনজ এর একটি ক্যাম্প এ গিয়েছিলাম কিন্তু আসার সময় কি একটা সমস্যার কারনে রাস্তা বন্ধ থাকায় আর ফিরতে পারলাম না ক্যাম্প এই থাকতে হলে এবং এটা ছিল আমার জীবনের নতুন এক অধ্যায় । সবাই চিন্তিত আমি, আমার পরিবার, বন্ধু বান্ধব । অবাক করা বিষয় হলো আমার বন্ধুরা আমার জন্য এতটাই আন্তরিক ছিল যে, তাবুর মধ্যে তো দুরের কথা তাবুর আশে পাশেও কাউকে কোন শব্দ করতে দেয়নি যাতে আমার ঘুম ভেঙ্গে যায় । এরপর আমি অনেক ক্যাম্প এ থেকেছি স্ট্যাডি ট্যুার এ গিয়েছি কোথাও কোন সমস্যা হয়নি । আমার বন্ধুরা কতটা আন্তরিক ছিল একটা উদাহরন দেই । আমরা আমাদের কলেজের  রোভার দল নিয়ে সেন্ট মার্টিন যাচ্ছিলাম নাফ নদী পাড় হচ্ছিলাম টলার/জাহাজ এ করে । নদীতে অনেক ঢেউ ছিল, এর মধ্যে হঠাৎ একটা বড়   ঢেউ এসে  আমাদের লাগ্যেজগুলো ফেলে দিচ্ছিল । আমি লাগ্যোজগুলো ধরতে গিয়ে প্রায় নদীতে পড়ে যাচ্ছিলাম আমাকে আরেকজন ধরে ছিল । পড়ে কলেজে এসে আমার এক বন্ধু মিলাদ মাহফিল এর আয়োজন করেছিল যে আমার কোন বিপদ হয়নি বলে ।
আমি তখন  একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকরী করি , বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিয়ে, জন্মদিন এগুলোর জন্য কোন ছুটি দিতে চায় না তাই আমার  জীবনের আঙটি বদলের দিন ঠিক করেছি ২১শে  ফেব্রয়ারী, বিয়ের তারিখ ঠিক করা  হলো ১৪ এপ্রিল এবং আমার সন্তানের জন্মদিন ১লা জানুয়ারী । এই কাজগুলো করা সম্ভব হয়েছে কারন আমাদের পরিবার, আমার পরিবার, আমার বন্ধু মহল, শুভাকাঙ্গী মহল সবাই আমার পাশে ছিল বলে । জানি এখন ও অনেক পথ পাড়ী দিতে হবে । তবুও হাল ছাড়া যাবে না । কারন এ যুদ্ধ নিজেকে যোদ্ধা হিসাবে তৈরী করার যুদ্ধ । নিজেকে যদি সৈনিক হিসাবেই তৈরী করতে না পারি তাহলে যুদ্ধ জয় করবো কি করে ।
উপরের আলোচনাগুরো একান্তই ব্যাক্তিগত তবুও শেয়ার করা উদ্দেশ্য হলো । আমরা অনেকেই উদ্যোক্তা হতে চাই । আমরা ব্যবসা করতে চাই । আমরা একদিনে কোটি টাকা ইনকাম করতে চাই । এই চাওয়াগুলোর মধ্যে দোষের কিছু নাই । তবে নিজেকে একটু খুজে দেখতে হবে । নিজেকে একটু আয়নার সামনে নিয়ে আসতে হবে । যে পথ পাড়ী দেব বলে ঠিক করেছি তার জোগার ঠিক মতো করেছি কিনা ? নাকি অন্যের প্ররোচনায় নিজেকে অজানার পথে ঠেলে দিচ্ছি যার খেসারত দিতে হবে । আপনাকে, আপনার পরিবারকে, আপনার বন্ধুকে সবাইকে ।
আপনি যে পথের পথিকই হন না কেন আপনাদের পরিবার , আপনার পরিবার, আপনার বন্ধু, শুভাকাঙ্খীরা  যদি সাথে না থাকে তাহলে আপনি একদিন পথহারা পথিক হয়ে ঘুরে বেড়াবেন এটা নিশ্চিত আর নয়তো আপনি এমন অনেক দুরে চলে যাবেন, যেখান থেকে আর কাউকে আপনি খুজে পাবেন না ।
সিদ্ধান্ত আপনার………………………………………………………………..।