উদ্যোগ এবং উদ্যোক্তার মানসিক স্বাস্থ্য !

সেদিন আমাদের  একজন উদ্যোক্তার নিমন্ত্রণ পেয়ে ডিনার করতে গিয়েছি । বিভিন্ন কথার প্রেক্ষিতে আড্ডার মাঝে দিয়ে আমাদের একজন বড় ভাই  একটি পদবীর কথা বললেন । পদবীটি হচ্ছো  CSO ( Chief Straggling Office ) এবং কিছু দিনের মধ্যে একটি  CSO summit আয়োনজন করতে যাচ্ছেন । আবার আমাদের পরিচিত একটি প্রতিষ্ঠান আছেন যারা  কিছুদিন ধরে নিয়মিতভাবে একটি প্রোগ্রাম আয়োজন করে আসছে যেখানে উদ্যোক্তারা তাদের ব্যর্থ উদ্যোগগুলো শেয়ার করেন যাতে করে  অন্য নতুন উদ্যোক্তারা এখান থেকে কিছু শিখতে পারেন । হোক না কোন পরিশ্রম এর গল্প নয়তো ব্যার্থতার গল্প, এর সাথে একটি বিষয়ে কিন্তু মিল রয়েছে আর সেটা হলো উদ্যোক্তার মানসিক স্বাস্থ্য । উদ্যোক্তার মানসিক স্বাস্থ্য যদি ভাল না থাকে তাহলে সে যেমন পরিশ্রম করার আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে তেমনি পরিশ্রম না করার কারনে এক সময়ের সফল উদ্যোগ ও ব্যার্থতায় রুপ নিতে পারে ।
আমাদের মাঝে অনেকেই আছেন, যারা নিজেদেরকে একজন উদ্যোক্তা হিসাবে দেখতে চান। নিজেই নিজের বস হতে চান এবং নিজে নিজের  উদ্যোগ এর মাধ্যমে, পরবর্তী Steve Jobs    অথবা Mark Zuckerberg  হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে পরিচিতি পেতে চান । তাদের প্রচার প্রচারনা, টি-শার্ট, ভিজিটিং কার্ড ইত্যাদি  দেখে মনে হয় না যে তাদের কোন ধারনা আছে যে, স্টার্টআপ  দুনিয়া কতোটা নির্দয় এবং কঠোর হতে পারে  ।
তারা কখনোই  নিজেরা কুন্ঠাবোধ করে না, তাদের সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করতে, এমনকি তাদের সীমার বাহিরে গিয়েও খরচ করতে । তারা তাদের সর্ম্পকগুলো গুটিয়ে নিয়ে আসে ঠিক যতটুকু তাদের না থাকলেই নয়, ততটুকু সীমার মধ্যে । অনেকরাত তারা নির্ঘুম কাটিয়ে দেয়, তারা তাদের উদ্যোক্তা হবার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য । তারা তাদের স্বপ্নের গাড়ীটা চালিয়ে যেতে থাকে ততক্ষণ, যতক্ষন না তাদের জ্বালানী শেষ হয়ে আসে অথবা তাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন হতে শুরু করে । বাংলাদেশে গত কয়েক বছরের  উদ্যোক্তা উন্নয়নের ইতিহাস দেখলে এমন অনেক ঘটনাই সামনে চলে আসবে । কিন্ত তাদের মধ্যে ঠিক কতোজন নিজেদের উদ্যোগ এর মাধ্যেমে নিজেদেরকে  Steve Jobs    অথবা Mark Zuckerberg  হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে, সেই সংখ্যাটা সহজে ইতিহাস থেকে খুজে পাওয়া যাবে কি ?
আমরা আমাদের স্টার্টআপ গুলোর জন্য যে পরিমান পরিশ্রম করি, সময় ব্যায় করি তারপরও কেন আমাদের স্টার্টআপগুলো দাড়াচ্ছে না বা সফলতার মুখ দেখতে পাচ্ছে না । এর মধ্যে অনেকগুলো কারন রয়েছে । তবে এতদিনপর মনে হয় সময় হয়েছে   একটা বিষয় নিয়ে বিশেষভাবে কথা বলার আর  সেটা হচ্ছে উদ্যোক্তার মানসিক স্বাস্থ্য , মানে উদ্যোক্তাদের মানসিক অবস্থা বা অবস্থান নিয়ে কথা বলার । একটি উদ্যোগকে  সফল করার পিছনে অনেকগুলো বিষয় কাজ করে এর মধ্যে উদ্যোক্তার মানসিক স্বাস্থ্য বা শক্তি একটি অন্যতম প্রভাবশালী নিয়ামক হিসাবে ভুমিকা পালন করে থাকে । আমরা যদি সফল উদ্যোক্তাদের জীবনীগুলো পড়ে দেখি তাহলে এর সত্যতা পাওয়া যাবে ।
অন্যভাবে বলা যায় যে, স্টার্টআপ উদ্যোক্তারা তাদের সময়, মেধা, বিনিয়োগ, ইত্যাদি ইতিবাচক বিষয়গুলো এমন অনিয়ন্ত্রিতভাবে তাদের স্টার্টআপ এর জন্য ব্যবহার করেন যে, এগুলোই এক সময় তাদেরকে হতাশ, উদ্বেগ, বিষন্নতায় ডুবিয়ে ফেলে । ফলে তখন আর তারা তাদের মানসিক শক্তিকে তাদের উদ্যোগ এর জন্য ব্যবহার করতে পারে না, শুধু তাই নয় এই হতাশা, উদ্বেগ, বিষন্নতা আস্তে আস্তে তাদের ব্যক্তিগত জীবনেও প্রভাব ফেলতে শুরু করে ।
এ বিষয়গুলো সম্পর্কে উদ্যোাক্তারা যে অনেক সচেতন তা কিন্তু নয় । বরং তাদের সচেতনতার অভাবের কারনেই উদ্যোক্তাদের এমন অসুবিধার মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে । আমাদের দেশের উদ্যোক্তারা অত্যান্ত সৃজনশীল, উচ্চাকাঙ্খী এবং তারা তাদের উদ্যোগ এর সাথে নিজেকে এমনভাবে জয়িয়ে ফেলেন যে, প্রতিষ্ঠানের পরিচয় এর নিচে ব্যাক্তিগত পরিচয় ঢাকা পড়ে যায় । যদি  কোন কারনে তাদের উদ্যোগ ব্যার্থ হয় তাহলে এটা তার নিজের ব্যক্তিগত  ব্যর্থতা বলে মনে করেন ।
তাদের সামনে তারা দুটি রাস্তা খোলা রাখে “সফলতা অথবা ব্যার্থতা” । ফলে তারা অনেক ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে থাকেন এবং আবেগপ্রবন হয়ে অনেক বিনিয়োগ করে থাকেন । ফলে তাদের নিজেরা ভেতর থেকে সফল হবার জন্য অস্থির হয়ে উঠে এমনকি নিজের সমালোচনা করার যে গুনাবলী তারা তাও হারিয়ে ফেলে । আদত দেখা যায় যে তারা তাদের ধের্য, নিজের উপর নিয়ন্ত্রন, হারিয়ে তাদের উদ্যোগটি আর সামনে নিয়ে যেতে পারে না ।
স্টার্টআপদের মধ্যে বেশিরভাগ উদ্যোক্তাই মনে করেন যে, তাদের উদ্যোগ অন্যদের চাইতে আলাদা এবং তাদের সমকক্ষ কেও নেই এবং অন্যরা কেও তাদের উদ্যোগ নিয়ে কথা বলবে না । অথচ তাদের বন্ধুরা, তাদের পরিবার এর সদস্যরাই বলেন যে’ঠিক বুঝতে পারছি না” আসলে কি করছে ? এবং তাদেরকে সেই উদ্যোগ থেকে ফেরানোর জন্য অফুরান চেষ্ঠা চালিয়ে যান যতক্ষণ না তারা ক্লান্ত হচ্ছেন বা উদ্যোক্তা তাদের কথা শুনছেন । এই অবস্থা স্বাভাবিক ভাবেই উদ্যোক্তার উপর একটি বাড়তী মানসিক চাপ  তৈরী করে ।
বর্তমান টেকনোলোজির যুগে, টেকনোলজি যেমন উদ্যোক্তাদের অনেক কাজ সহজ করে দিয়েছে অন্যদিকে কেড়ে নিয়েছে তাদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা, সময়, ধৈর্য  ইত্যাদি । সবাইকে টেকনোলজি যেন একটাই কথা বলছে “ দ্রুত করতে হবে দ্রুত” । এই দ্রুত করার যে, প্রতিযোগীতা সেই প্রতিযোগীতায় দৌড়াতে না পেড়ে অনেক উদ্যোক্তাই হাল ছেড়ে দিচ্ছেন আবার অনেক উদেক্তা তাদের ব্যক্তিগত জীবন এবং উদ্যোক্তা জীবন এর মাঝে তাল মেলাতে না পেড়ে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ছে ।
স্টার্টআপ উদ্যোগ এর একটি   অন্ধকার দিক হলো, উদ্যোক্তারা    এতটাই মোহগ্রস্থ থাকে যে, তারা তাদের মানসিক স্বাস্থ্যকে ঝুকিতে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করেন না । এটা সত্য যে এর সমাধানটা কঠিন তবে কিছু কিছু পদক্ষেপ উদ্যোক্তাদের এ সমস্যা হতে কিছুটা হলেও সমাধান দিতে পারে ।
প্রথম হচ্ছে আপনি যে উদ্যোগটি নিতে যাচ্ছেন সেই উদ্যোগ সম্পর্কে আগে কাছের লোকেদের সাথে পরামর্শ করুন , হতে পারেন তিনি আপনার বন্ধু অথবা পরিবারের কেও । এরপর আপনি আপনার উদ্যোগের ব্যাপারে আপনার ক্লায়েন্টদের সাথে যোগাযোগ বৃদ্ধি করুন যাতে করে তারা আপনার উদ্যোগটিকে নিজের সমস্যার সমাধান হিসাবে গ্রহণ করেন আর এই কাজটি তখনই সফলভাবে করা সম্ভব হবে যখন আপনার কাজের মধ্যে আপনার নিজের সৃজনশীলতার ছাপ আপনি রাখতে পারবেন । আপনার উদ্যোগটি অন্যকে অনুকরন করে তৈরী না করে অন্যের অনুকরন যোগ্য করে তৈরী করতে পারবেন । আপনি যখন আপনার উদ্যোগের মাধ্যমে অন্যের সমস্যার সমাধান করতে পারবেন, তখন আপনার হয়েই আপনার ক্রেতারা এটিকে এগিয়ে নিতে সহযোগীতা করবেন । ফলে আপনি মানসিকভাবে অনেকটাই  স্বস্তিবোধ করবেন এবং এর প্রভার আপনার ব্যক্তিগত জীবনেই পড়বে । ফলে আপনি আপনার উদ্যোগকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে উৎসাহবোধ করবেন, সময় পাবেন এবং আত্নতৃপ্তি পাবেন , যা আস্তে আস্তে আপনার মানসিক স্বাস্থ্যকে সুস্থ রাখতে সহযোগীতা করবে ।

 



Leave a Reply